ইয়েলো বেলিড সী স্নেক এর সাধারণ পরিচিতি
সাপ নামটা শুনলে সবাই প্রাথমিকভাবে ভয় পেলেও সাপের সৌন্দর্য একবার যে দেখে সে সাপের সৌন্দর্য্য ও বৈচিত্র্যময়তার প্রেমে পড়ে যায়।আর সৌন্দর্যের প্রতিযোগিতায় সামুদ্রিক সাপগুলোর তুলনা সাপগুলো নিজেই।তেমনি একটি সাপ হলো ইয়েলো বেলিড সী স্নেক (Yellow Belied Sea Snake) বা হলুদ পেটের সামুদ্রিক সাপ।কালো-নীল দেহে উজ্জল হলুদের ছোঁয়া এ সাপকে দেখতে সুন্দর করে তুলেছে।মারাত্নক বিষাক্ত এই ইয়েলো বেলিড সী স্নেক আটলান্টিক মহাসাগর ব্যাতীত পৃথিবীর উষ্ণমন্ডলীয় সকল মহাসাগরীয় পানিতে এর উপস্থিতি লক্ষ করা যায়।
হলুদ পেটের সামুদ্রিক সাপটি একটি দুর্দান্ত ডুবুরি, এরা সমুদ্রের গভীর পানিতে ডুব দিয়ে পানির নিচেই এক ঘন্টা থেকে আর বেশি সময় পর্যন্ত থাকতে পারে। তবে স্থলভাগে এই সাপটি অসহায়।
বাংলাদেশে কয়েক প্রজাতির সামুদ্রিক সাপ দেখা যায় যেমনঃ ইয়েলো বেলিড সী স্নেক, মালাক্কা সী স্নেক, এস্টুয়ারিন সী স্নেক, ইয়েলো লিপড সী ক্রেইট, হুক-নোজড সী স্নেক,ডাউডিন’স সী স্নেক, নেরো হেডেড সী স্নেক,ম্যালাবার সী স্নেক, ক্যান্টর’স নেরো হেডেড সী স্নেক, এনুলেটেড সী স্নেক,স্ট্রীপড সী স্নেক, ব্ল্যাক ব্যান্ডেড সী ক্রেইট প্রভৃতি। প্রতিটি সাপই সৌন্দর্যের বিচারে অনন্য।
ইয়েলো বেলিড সী স্নেক এর বৈজ্ঞানিক শ্রেণিবিন্যাস
Kingdom: Animalia
Phylum: Chordata
Class: Reptilia
Order: Squamata
Suborder: Serpentes
Family: Elapidae
Genus: Hydrophis
Species: Hydrophis platurus
আপনি কি অত্যন্ত বিষধর কালাচ সাপ সম্পর্কে জানেন?? না জানলে এখনই জেনে নিব কেননা এ সাপ মানুষের বিছানায়ও অনেক সময় আশ্রয় নেয়…
বর্ণনা
ইয়েলো বেলিড সী স্নেক এর মাথা সরু, দেহ পাতলা, পাশ থেকে একদিকে সংকুচিত, দেহের পশ্চাৎ অংশ এর ঘাড়ের ব্যাসের অর্ধেকেরও (ব্যাসার্ধেরও) কম, লেজ দীর্ঘ এবং সমতল।একটি পুরুষ হলুদ পেটের সামুদ্রিক সাপ ২৮ ইঞ্চি বা ২.৪ ফুট এবং মহিলা সাপ ৩৫ ইঞ্চি বা ২.৯ ফুট পর্যন্ত দীর্ঘ হয়।আবার পুরুষ সাপের লেজের দৈর্ঘ্য ৩.১ ইঞ্চি বা ৮০ মিলিমিটার এবং মহিলা সাপের লেজ ৩.৫ ইঞ্চি বা ৯০ মিলিমিটার পর্যন্ত হয়।
সাপটির শরীরে মসৃণ আঁইশ থাকার দরুণ সাপের দেহটি অত্যন্ত কোমল ও মসৃণ হয়। আঁইশগুলো আকৃতিতে উপচতুর্জুজাকার, শরীরের মোটা অংশের চারপাশে ২৩-৪৭ সারিতে পাশাপাশি অবস্থান করে অর্থাৎ জুক্সটাপোজ। উদরের আঁইশগুলো খুবই ছোট হয় এবং সংখ্যায় ২৬৪ থেকে ৪০৬ টি হয়। সাধারণত উদরীয় আঁইশ গুলোকে শরীরের আঁইশ থেকে আলাদা করা যায়না তবে যদি আলাদা হয় তবে তা অনুদৈর্ঘ্যিক খাঁজ দ্বারা পৃথক থাকে।
ইয়েলো বেলিড সী স্নেক এর মাথাটি সরু কিন্তু প্রসারিত থুতনি বিদ্যমান।সাপটির মাথার ঢালগুলি সম্পূর্ণ, নাকের ছিদ্রগুলি উন্নত এবং অনুনাসিক ঢালগুলি একে অপরের সাথে যুক্ত থাকে।
সাপটির রং পরিবর্তনশীল হলেও অধিকাংশই একটি স্বতন্ত্র দ্বিবর্ণ রঙের প্যাটার্ণ দেখা যায়,পিঠের দিকটায় কালো এবং পেটের দিকটায় হলুদ বা বাদামী।এদের পিঠ ও উদরীয় অংশের রঙ সহজেই চিহ্নিত করা যায় এবং তা ভিন্ন কালার দ্বারা নির্দেশিত।অনেকক্ষেত্রে উদরের হলুদ বা বাদামী অংশে কালো বিন্দু বা দাগ থাকতে পারে অথবা হলুদ রঙটি পিঠ বরাবর প্রসারিত হতে পারে তাই এদের মধ্যেবর্তী সরু কালো ডোরা বা আড়াআড়িভাবে কালো সারির দাগ বিদ্যমান।

ইয়েলো বেলিড সী স্নেক এর বৈজ্ঞানিক নামকরণ
১৭৬৬ সালে সুয়েডীয় উদ্ভিদবিজ্ঞানী, চিকিৎসক ও প্রাণীবিজ্ঞানী ক্যারোলাস লিনিয়াস হলুদ-পেটযুক্ত সামুদ্রিক সাপের নাম দেন Anguis platura. যার Anguis মানে হলো সাপ। কিন্তু ফরাসী প্রাণীবিদ ফ্রাঁসোয়া মারি দাউডিন ১৮০৩ সালে নতুন গণ (জেনাস) পেলামিস তৈরী করেন এবং এই সাপকে নতুন জেনাসের আওতায় এনে নামকরণ করেন Pelamis platuros. যার Pelamis শব্দটি এসেছে “টুনি ফিশ এর প্রাচীন গ্রীক শব্দ থেকে, যা একটু মেয়েলি বিশেষ্য, যার অর্থ ছোট বা ছোট টুনি মাছ। আর platurus শব্দটি এসেছে প্রাচীন গ্রীক শব্দদ্বয় “platys ” যার মানে সমতল এবং ” oura ” যার মানে লেজ থেকে। সুতরাং platurus এর মানে দাড়ায় সমতল লেজ। পরবর্তীতে platurus এর -us এর পরিবর্তে -a ব্যবহার করা হয় অর্থাৎ pelamis platura. এ নামের বিস্তৃত সমার্থক শব্দ থেকেই ইয়েলো বেলিড সী স্নেক বা হলুদ পেটের সামুদ্রিক সাপের নামকরণ করা হয়েছে Hydrophis platurus. অনেক বছর যাবৎ এটা মনোটাইপিক জেনাস পেলামিস হিসেবে পরিচিত থাকলেও বর্তমান সময়ের বিভিন্ন আণবিক প্রমাণগুলি এটাকে হাইড্রোফিস জেনাসের আওতাভুক্ত হিসেবে প্রমাণ করেছে।
মারাত্নক বিষধর সাপ রাসেল’স ভাইপার সম্পর্কে না জানলে এখনই জানুন….
ইয়েলো বেলিড সী স্নেক এর আবাস
ইয়েলো বেলিড সী স্নেক বিশ্বের উষ্ণমন্ডলীয় সামুদ্রিক পানির একটি সাপ যা অন্যান্য সামুদ্রিক সাপের তুলনায় বেশী বিস্তৃত। এদের বিস্তৃত হওয়ার বিষয়টি নির্ভর করে জলের তাপমাত্রা, সামুদ্রিক স্রোত এবং বতমান সময়ের স্থল সেতুগুলোর গঠন এর উপর।এরা সম্পূর্ণভাবে সামুদ্রিক। বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই এদের সমুদ্রের প্রবাহ রেখায় দেখা যায় এবং সমুদ্রের চারপাশে ছড়িয়ে পড়ার জন্য সমুদ্রের স্রোত ও ঝড়ের সহায়তা নেয়।
ইয়েলো বেলিড সী স্নেক গ্রীষ্মমন্ডলীয় ইন্দো-প্যাসিফিক, কোস্টা রিকা, হাওয়াইয়ান দ্বীপপুঞ্জ, দক্ষিণ-পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার উপকূল, কোকোস দ্বীপপুঞ্জ, আটলান্টিক মহাসাগর, প্রশান্ত মহাসাগর, আফ্রিকার পূর্ব উপকূলের সমস্ত দেশে, জিবুতি, ইরিত্রিয়া, কেনিয়া, মাদাগাস্কার, মরিশাস, মায়োট, মোজাম্বিক, রিইউনিয়ন, সেশেলস, সোমালিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা এবং তানজানিয়ার সমস্ত পূর্ব দ্বীপ, ভারত মহাসাগর এবং বাংলাদেশের সামুদ্রিক অঞ্চলগুলোতে দেখতে পাওয়া যায়।
বাংলাদেশের কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত,কালাদিয়া চর, সেন্টমার্টিন, কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের বিভিন্ন উপকূলে এদের উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে।

হলুদ পেটের সামুদ্রিক সাপের অভিযোজন
ইয়েলো বেলিড সি স্নেক এর সমগ্র জীবন যেহেতু সমুদ্রে কাটে তাই সামুদ্রিক জীবনে তাদের সঙ্গম, খাবার পদ্ধতি এবং প্রজননপ্রক্রিয়া পুরোপুরি অভিযোজিত হয়। এছাড়াও সামুদ্রিক জীবনে অভিযোজনগুলের মধ্যে থাকে
উদরীয় আঁইশের আকার হ্রাস পাওয়া, শরীর পার্শ্বীয়ভাবে চেপে যাওয়া, সাঁতারের জন্য প্যাডেল লেজ, ভালভড নাসারন্ধ্র, সামুদ্রিক পানি বের হওয়ার জন্য প্যালাটাইন সীল এবং পানির নিচে ডুবের সময় বৃদ্ধি করার জন্য গ্যাসের ত্বকীয় বিনিময়।
হলুদ পেটের সামুদ্রিক সাপের প্রজনন
হলুদ পেটের সামুদ্রিক সাপগুলো উষ্ণ জলে বংশবিস্তার করে।এরা ওভোভিভিপারাস অর্থাৎ এরা সরাসরি জীবন্ত বাচ্চা প্রসব করে।এদের গর্ভধারণের সময়কাল ৬ মাস।ডিটমার্সের ধারণা অনুয়ায়ী, জোয়ারভাটা চলাকালে মহিলা সাপগুলো অল্পবয়সী থাকে। এরা সাগরের পানির উপরিভাগে বাচ্চা প্রসব করে।নতুন জন্মগ্রহণ করা একটি বাচ্চা ৩৮ সেন্টিমিটার বা ১৫ ইন্চি পর্যন্ত হয়।
কালাচ সাপ যা ঘামচিতি সাপ নামেও পরিচিত কিন্তু কেন?? এ সম্পর্কে না জেনে থাকলে এখনই জানুন….
হলুদ পেটের সামুদ্রিক সাপের শ্বসন ও খাবার
হলুদ পেটের সামুদ্রিক সাপ টি পানিতে ডুবে থাকার সময় ও সাঁতার কাটার সময় ত্বকের গ্যাসীয় বিনিময়ের মাধ্যমে তাদের প্রয়োজনের ৩৩ শতাংশ পর্যন্ত অক্সিজেন গ্রহণ করতে পারে।বাকীঅংশ তারা নাসারন্ধ্রের দ্বারা পূরণ করে।
যেহেতু এরা সামুদ্রিক সাপ তাই এদের বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় খাবার ও পানি সমুদ্রেই বিদ্যমান।এদের প্রধান খাবার তালিকায় থাকে সামুদ্রিক মাছ তবে বড় ধরণের সামুদ্রিক মাছ যেমন হাঙর মাছ এদের অপছন্দের তালিকায় থাকে।
সামুদ্রিক সাপগুলির নীচের চোয়ালে একটি বিশেষ লবণ গ্রন্থিও থাকে যা সামুদ্রিক জল থেকে লবণ ফিল্টার করে বলে একসময় বিশ্বাস করা হতো।কিন্তু সামুদ্রিক সাপগুলো সবসময় বিশুদ্ধ জল পান করে বলে এমন ফিল্টার থাকে।
ইয়েলো বেলিড সী স্নেক এর শিকার পদ্ধতি
ইয়েলো বেলিড সী স্নেক টি সাধারণত উল্টোদিকে সাঁতার কাটে।শিকার ধরার সময় এরা দুই সাগরের স্রোতের সংগমস্থল যেখানে পানি স্থির থাকে সেখানে উল্টো সাঁতার কাটতে থাকে।সামুদ্রিক ছোট মাছ কিংবা মাছের বাচ্চাগুলো এই জায়গার প্লাংটন খায়।বাচ্চাগুলো যখন মুক্ত হয়ে সাতার কাটতে থাকে তখন বিপরীত পাশ থেকে মাছটিকে আক্রমণ করে এবং বিষদাত দিয়ে বিষ মাছের শরীরে ঢুকিয়ে দেয়।মাছটি নড়াচড়া বন্ধ না করা পর্যন্ত এমনভাবে ধরে থাকে।নড়াচড়া বন্ধ করলে প্রথমে মাছটির মাথা খেয়ে ফেলে। এটি শিকার করার জন্য নিউরোটক্সিক বিষ ব্যবহার করে।
এছাড়াও তারা শিকারকে আকৃষ্ট করার জন্য এরা কয়েকহাজার সাপ একসাথে লাইন আকারে উপভোগ্য দৃশ্য বানাতে সক্ষম। যেমনঃ কয়েকহাজার হলুদ পেটের সামুদ্রিক সাপকে ৩ মিটার প্রশস্ত এবং 95 কিলোমিটার দীর্ঘ লাইনে একসাথে সাঁতার কাটতে দেখা গেছে।

ইয়েলো বেলিড সী স্নেক এর বিষক্রিয়া
অন্যান্য সামুদ্রিক সাপের মতে এদের বিষও অনেক শক্তিশালী এবং মারাত্মক বিষাক্ত। ইয়েলো বেলিড সী স্নেক এর বিষে বিভিন্ন নিউরোটক্সিন এর সাথে দুইরকমের আইসোটক্সিনও পাওয়া যায়। এই সাপের ত্বকনিম্নস্থ (LD50) হলো ০.০৬৭ মি.গ্রা./কে.জি.। প্রতি কামড়ে এই সাপ ১.০-৪.০ মিলিগ্রাম পর্যন্ত বিষ ঢালে।হলুদ পেটের সামুদ্রিক সাপের প্রয়োগকৃত বিষের কারণে আক্রান্তের কঙ্কাল পেশীর ক্ষতি, বৃক্কের ক্ষতি কিংবা মায়োগ্লোবিনুরিয়া, নিউরোমাসকুলার প্যারালাইসিস হতে পারে।
ইয়েলো বেলিড সী স্নেক এর এন্টিভেনম
শুধু বাংলাদেশ নয়,পৃথিবীর কোনোদেশেই এ সাপ মানুষকে দংশন করেছে এমন কোনো তথ্য এখনও পাওয়ায় যায়নি।তাই এই সাপের বিষের এন্টিভেনম নাই বললেই চলে।তবে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন শহরে অবস্থিত কমনওয়েলথ সিরাম ল্যাবরেটরিজ লিমিটেড Enhydrina schistosa নামক সামুদ্রিক সাপের বিষ দিয়ে ইয়েলো বেলিড সী স্নেক এর বিষ কে নিষ্ক্রিয় করেছে।যা কার্যকরভাবে সম্পন্ন হয়েছে।
এই সাপ সম্পর্কে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়
ইয়েলো বেলিড সী স্নেক এর মারাত্নক বিষের কথা সবারই জানা এজন্য অনেক মানুষই এ সাপ দেখলে সাপকে উদ্যত হয়।যা একদমই উচিত নাহ কেননা এই সাপ ভয়ঙ্কর বিষাক্ত হলে কামড়ায়না।ইতিপূর্বে এমন কোনো ইতিহাসও নেই। মন-মানসিকতা পরিবর্তন করতে হবে।সাপ আমাদের কোনো ক্ষতি করেনা বরং পরিবেশের জন্য উপকারী।সাপ ততক্ষণ পর্যন্ত আক্রমণ করেনা যতক্ষণ না আক্রমণের শিকার হয় কিংবা পালানোর পথ না পায়।তাই সাপকে না মেরে প্রকৃতিতে ফেরার সুযোগ দিন।প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও সম্পদের সংরক্ষণ করুন।
যে কোনো বিষয়ে জিজ্ঞাসা থাকলে
Reference
ইয়েলো বেলিড সী স্নেক উইকিপিডিয়া,
আরোও পড়ুন