রাণীক্ষেত রোগ কী?
রাণীক্ষেত রোগ (Newcastle Disease) একটি ভাইরাল ডিজিস অর্থাৎ ভাইরাসবাহিত রোগ। এটি একটি মারাত্মক সংক্রামক রোগ হওয়ায় খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।বিভিন্ন খামারের হাঁস-মুরগী ও কবুতরের গণহারে মৃত্যুর জন্য দায়ী হলো এই রাণীক্ষেত রোগ। এই রোগ পৃথিবীর মোটামুটি সব দেশেই পাওয়া যায় যা বছরের যেকোনো সময় আপনার হাঁস-মুরগি বা কবুতরকে সংক্রমণ করতে পারে। কবুতরের রাণীক্ষেত রোগ আপনার পালিত সকল কবুতরকে সংক্রমিত করে খামারশূণ্য করতে পারে।
কবুতরে রাণীক্ষেত রোগের কারণ কী?
- রাণীক্ষেত রোগের জন্য দায়ী ভাইরাস হলো Newcastle Disease Virus( NDV) বা Paramyxo Disease Virus (PMV). প্যারামিক্সো ডিজিস ভাইরাসের অনেকগুলা স্ট্রেইন বা রূপ রয়েছে যার প্রত্যেকটিই বিভিন্ন প্রাণীতে ভিন্ন ভিন্ন রোগ সৃষ্টির জন্য দায়ী। তন্মধ্যে দুইটি স্ট্রেইন রাণীক্ষেত রোগ সৃষ্টির জন্য দায়ী।
- সকল ধরণের হাঁস-মুরগী ও টার্কিতে রাণীক্ষেত রোগ সৃষ্টির জন্য দায়ী স্ট্রেইন হলো Paramyxo Disease Virus-1 (PMV-1).
- সকল জাতের পাখি ( কবুতর, কোয়েল) তে রাণীক্ষেত রোগ সৃষ্টির জন্য দায়ী স্ট্রেইন হলো Avian/Pigeon Paramyxo Disease Virus-1 (PPMV-1)
আজকে আমরা কবুতরের রাণীক্ষেত রোগ নিয়ে আলোচনা করবো-
কবুতরের রাণীক্ষেত রোগ কীভাবে ছড়ায়?
- কবুতরের রাণীক্ষেত রোগ একটি ভাইরাসবাহিত রোগ হওয়ায় খুব সহজ ও স্বল্প সময়ের মাঝেই ব্যাপকহারে বিস্তার লাভ করতে পারে। আবার এই ভাইরাস ইনএক্টিভেটেড অবস্থায়ও ৭-১৪ দিন পর্যন্ত বাঁচতে পারে।
- যেসব কবুতর শেডের বাহিরে গিয়ে অন্য কবুতরদের সাথে উড়ে,মিশে বা খাবার খায় তাদের মাধ্যমেই এই রোগ আপনার শেডে ছড়িয়ে পড়বে।
- সংক্রমিত কবুতরের সাথে একই খোপে যেসব কবুতর থাকবে তাদের মাঝেও ভাইরাসটি বিস্তার করবে।
- সংক্রমিত কবুতরের খাওয়া এটো খাবার বা পানির মাধ্যমেও অন্য কবুতরে ছড়াবে। কবুতর রক্ষণাবেক্ষণে ব্যবহৃত জিনিসপত্রের দ্বারা ছড়াতে পারে।
- কবুতরের যত্ন নেওয়া ব্যক্তির মাধ্যমে অন্য কবুতরে সংক্রমণ করতে পারে।
- সংক্রমিত কবুতরের ত্যাগকৃত মলে/বিষ্ঠা বা শরীরের কোনো অংশের মাধ্যমে ছড়াতে পারে।
- আক্রান্ত কবুতর তার বাচ্চাকে খাইয়ে দিলে বাচ্চাটিও এই রোগে আক্রান্ত হবে।
- রাণীক্ষেত রোগে আক্রান্ত কবুতরের খামার থেকে কবুতর নিয়ে আসলে। এক্ষেত্রে পরিবহন মাধ্যমেও (খাঁচা, গাড়ী, বক্স) ভাইরাসটি বিস্তার করতে পারে।
- মোট কথা হলো আক্রান্ত কবুতর যেসব কবুতর বা জিনিসপত্রের সংস্পর্শে আসবে সেখানেই ভাইরাসটি বিস্তার করতে থাকবে।
রাণীক্ষেত রোগের লক্ষণ
- রাণীক্ষেত রোগের ভাইরাস কবুতরের শ্বসনতন্ত্র, পরিপাকতন্ত্র ও স্নায়ুতন্ত্রে আঘাত হানে। যার ফলে একসাথে অনেকগুলো লক্ষণ দেখা যেতে পারে।
- প্রাথমিকভাবে সংক্রমিত কবুতরগুলোকে কোনোস্থানে চুপচাপ বসে ঝিমাতে দেখা যাবে।
শ্বসনতন্ত্রে সংক্রমণের লক্ষণ
- শ্বসনতন্ত্রের সাথে সম্পৃক্ত অঙ্গগুলিকে সংক্রমিত করে এদের স্বাভাবিক কার্যাবলি বাধাগ্রস্থ করে ফলে শ্বাসকষ্ট হয়।
- নাক দিয়ে জেলির মতো তরল আসা।
- নাক দিয়ে নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হওয়ার কারণে হা করে জোরে জোরে শ্বাস নেওয়া।
পরিপাকতন্ত্রে সংক্রমণের লক্ষণ
- সবুজ রঙের অথবা সাদা চুনের মতো পাতলা মলত্যাগ করে।
- বমি করবে।
- খাবারের প্রতি অনীহা থাকবে।
স্নায়ুতন্ত্রে সংক্রমণের লক্ষণ
- পা ও পাখনা প্যারালাইজড বা অবশ হয়ে যাওয়া।
- ঘাড় বেঁকে যাওয়া বা অস্বাভাবিক হয়ে যাওয়া।
- ঠিকঠাক ভাবে উড়তে না পারা।
- উড়ার সময় পড়ে বা উল্টে যাওয়া।
- বাঁকা বা গোলাকার পথে হাঁটা।
- শরীরের যেকোনো অংশ (যেমনঃ মাথা, ডানা অথবা চোখ) এ সূক্ষ্ণ কম্পন হওয়া।
- খাবার খাওয়ার সময় দানা ঠোঁটে নিতে না পারা কিংবা নিলেও পড়ে যাওয়া।
- চোখ দিয়ে পানি বের হওয়া।
রাণীক্ষেত রোগের চিকিৎসা
রাণীক্ষেত রোগের প্যারামিক্সো ভাইরাস একবার আক্রমন ঘটালে তাকে প্রতিহত করা দুষ্কর বললেই চলে। চিকিৎসা চালিয়ে গেলেও এই রোগ ভালো হয়না। তবে আক্রান্ত কবুতরকে তো আর ফেলে দেওয়া যাবেনা। জীবন থাকা পর্যন্ত রোগ মুক্ত করার চেষ্টা করা আপনার দায়িত্ব। এক্ষেত্রে যেসব দিক খেয়াল রাখা জরুরি –
- সংক্রমিত হওয়ার লক্ষণ বুঝতে পারা মাত্রই কবুতরটিকে দল থেকে আলাদা করে ফেলতে হবে। সাথে সাথে রাণীক্ষেত রোগের টিকা দিতে হবে।
- আক্রান্ত কবুতরটিকে অপেক্ষাকৃত গরম জায়গায় রাখতে হবে।
- আক্রান্ত কবুতরের শরীরের ইমিউনো সিস্টেম ক্ষতিগ্রস্থ হবে ফলে অন্যান্য রোগ (যেমনঃ কক্সিডিওসিস, ট্রাইকোমোনিয়াসিস, এস্পারজিলোসিস) প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাবে তাই সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে এবং ওই কবুতরের থাকার জায়গা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে।
- আক্রান্ত কবুতরকে ক্যালসিয়াম ও ভিটামিনসমৃদ্ধ খাবার এবং ঔষধ দিতে হবে।অসুস্থ কবুতরটিকে হ্যান্ড ফিডিং করাই উত্তম হবে।
- পানির চাহিদা পূরণের জন্য ইলেক্ট্রোলাইট স্যালাইন খাওয়ানো যেতে পারে।
- Tylovet 10g বা Doxy-A-Vet পাউডার প্রতি লিটার পানিতে ১ গ্রাম মিশিয়ে প্রতি কবুতরকে ১০ গ্রাম করে পানি খাওয়ালে উপকার হতে পারে।
- এভাবে চলার ৬ সপ্তাহ পর্যন্ত যদি কবুতরের মৃত্যু না হয় তবে এই কবুতরের দ্বারা অন্য কবুতরে আর কেনে সংক্রমণ হবেনা বলে ধরে নেওয়া হয়।
- রাণীক্ষেত বা যেকোনো রাগের লক্ষণ বুঝতে পারা মাত্রই অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ভেট ডাক্তার যিনি কবুতর চিকিৎসা করেন তার সাথে কথা বলবেন এবং তার নির্দেশনা অনুযায়ী ঔষধ খাওয়াবেন তা না হলে হিতে বিপরীত হওয়ার সম্ভবনাই বেশী থাকবে।
কবুতরের রাণীক্ষেত রোগের প্রতিরোধ পদ্ধতি
রাণীক্ষেত রোগের চিকিৎসা বা প্রতিকার করার চেয়ে প্রতিরোধ করা হাজার গুণে উত্তম।এক্ষেত্রে যেসব বিষয়গুলো জানা জরুরি তা হলো-
- আলো বাতাস যায় এমন শেডে কবুতর রাখতে হবে।
- অন্য বাসার কবুতরের সাথে যাতে না মিশে সেটা খেয়াল করতে হবে।
- সময়মতো রাণীক্ষেত রোগের টিকা দিতে হবে।টিকা দেওয়ার সকল বিষয় জেনে নিন-
কবুতরের রাণীক্ষেত রোগ এর ভ্যাকসিন
- কবুতরের রাণীক্ষেত রোগের জন্য দুইধরণের ভ্যাকসিন পাওয়া যায়।
- লাইভ ভ্যাকসিন – যা ভাইরাসের কার্যকারিতা নষ্ট করবে কিংবা সাময়িক সময়ের জন্য দমিয়ে রাখবে। যার স্থায়িত্বকাল ৪০-৪৫ দিন।এই ভ্যাকসিন দেওয়ার পর অবশিষ্ট অংশ পুড়িয়ে ফেলতে হবে এবং মাটিতে যেনো না পড়ে সেটা খেয়াল করতে হবে।
- কিল্ড ভ্যাকসিন- এটি ভাইরাসকে একবারে মেরে ফেলবে। যার স্থায়িত্বকাল ১ বছর প্রায় এখানে কিল্ড ভ্যাকসিনগুলো নিয়েই কথা বলা হয়েছে।
টিকার নাম
- কবুতরের রাণীক্ষেত রোগ বা প্যারামিক্সো ভাইরাস প্রতিরোধের জন্য সবচেয়ে কার্যকরী টিকাগুলো হলো-
- রেনাটা কোম্পানির চেভিভ্যাক (Chevivac- P200, Renata) – প্রতি ডোজ ০.২৫ মি.লি
- কলোম্বোভ্যাক পিএমভি ভ্যাক (Colombovac PMV Vaccine) – প্রতি ডোজ ০.২ মি.লি.
- এভিয়ান পিমভি ভ্যাক (Avian PMV vaccine)- প্রতি ডোজ ০.২ মি.লি. যার সবগুলোই কিল্ড ভ্যাকসিন।
- যেকোনো ভেটেরিনারি দোকানে এর যেকোনো একটি পাওয়া যাবে। তবে চেভিভ্যাক বেশী জনপ্রিয় ও সহজলভ্য।
টিকা দেওয়ার নিয়ম

- টিকার নামের সাথে দেওয়া ডোজের পরিমাণ কবুতরের ঘাড়ের চামড়ার নিচে পুশ করতে হবে।
- কবুতরের ম্যাটিং বা ডিম সংগ্রহের ৫-৬ সপ্তাহ আগে কবুতরের রাণীক্ষেত রোগের টিকা দিতে হয়।
- ডিম ফুটে বাচ্চা আসার ৩-৫ সপ্তাহের মাঝে বাচ্চাটির রাণীক্ষেতের টিকা দিতে হবে তারপর ৪ সপ্তাহ পর আবার রাণীক্ষেতের বুস্টার ডোজ দিলে ১ বছরের জন্য নিরাপদ।
- বিভিন্ন রেসিং, প্রতিযোগীতা বা প্রদর্শনীর ৪-৬ সপ্তাহ পূর্বে রাণীক্ষেতের কিল্ড টিকা দিতে হবে।
সতর্কতা
- কবুতরকে বেশী চাপ প্রয়োগ করে ধরা যাবেনা।
- ঘাড়ের চামড়ার নিচে ব্যতীত পা বা পাখনায় ভ্যাকসিন দেওয়া যাবেনা।
- অত্যাধিক গরমের সময় ভ্যাকসিন দেয়া যাবে না।
- ভ্যাকসিনেশন এর আগেই কবুতরগুলোকে লিভার টনিক দিতে হবে।
- ভালো ও সুষম খাদ্য খাওয়াতে হবে।
- সকাল বা রাতের দিকে যখন আবহাওয়া ঠান্ডা থাকে তখন ভ্যাকসিন প্রয়োগ করা উত্তম। ভ্যাকসিন প্রয়োগ করার দিন ইলেক্ট্রোলাইট স্যালাইন খাওয়ালে ভালো।
- ভ্যাকসিনেশন করার একদিন পর থেকে ৩-৪ দিন মাল্টিভিটামিন খাওয়াতে হবে।
আজ এই পর্যন্তই। কবুতরের রাণীক্ষেত রোগ বিষয়েযেকোনো জিজ্ঞাসা থাকলে আমাদের সাথে যোগাযোগ করতে পারেন।ধন্যবাদ।
রেফারেন্স
বইঃ কবুতর পালন পদ্ধতি
ছবিঃ উইকিপিডিয়া

