হাঁসের রোগ-ব্যাধি ও চিকিৎসা

হাঁসের রোগ-ব্যাধি ও চিকিৎসা

হাঁসের জীবনচক্রে হাঁসের রোগ-ব্যাধি ও চিকিৎসা এই বিষয়গুলোর সাথে খুবই কম পরিচিত হতে হয়। ।হাঁসের রোগ-ব্যাধি বলতে দু’একটি বড় হাস ফিতা কৃমি দ্বারা আক্রান্ত হ’লেও সচরাচর হাঁসের কৃমি রোগ হয় না । উকুঁন বা অন্যবিধ প্যারাসাইট দ্বারা হাঁসেরা আক্রান্ত হয় না তবে মুরগীর যে সকল রোগ হয়, হাঁসেরাও কদাচিৎ সেই সকল রোগের দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে। হাঁসের এসব রোগের চিকিৎসা ব্যবস্থা মুরগীর রোগ-ব্যাধির চিকিৎসা ব্যবস্থার অনুরূপ। হাঁসেরা অবশ্য কলেরা ভাইরাস, হেপাটাইটিস, কীল রোগ ও প্লেগ রোগে আক্রান্ত হতে পারে।রাণীক্ষেত রোগে হাসেরা মাঝেমধ্যে আক্রান্ত হয়ে থাকে। তারপরও দেখে নেওয়া যাক হাঁসের রোগ-ব্যাধি ও চিকিৎসা সংক্রান্ত সকল দিকসমূহ :

কলেরা রোগ (Cholera)

  • হাঁসের কলেরা রোগ ব্যাক্টেরিয়া ঘটিত কারণেই সূচিত হয়ে থাকে।
  • এই রোগটি একটি মারাত্মক সংক্রামক রোগ – অতি অল্প সময়ের মধ্যে ব্যাপকভাবে প্রসারলাভ করতে পারে।

কারণ

  • প্যাসটুরেলা অ্যাভিসিডা (pasturella avisida) নামক এক প্রকার জীবাণু কর্তৃক এই রোগ সংঘটিত হয়ে থাকে।
  • অতএব উপরোক্ত জীবাণুই হাঁসদের কলেরা রোগের অন্যতম কারণ হিসাবে বিবেচিত হয়ে থাকে।

লক্ষণ

  • কলেরা রোগের দ্বারা আক্রান্ত হয়ে সুস্থ ও সবল হাঁসও হঠাৎ মারা যেতে পারে।
  • দুর্বলতা , ঝিমুনি-ভাব ও নিষ্ক্রিয়তা এই রোগের অন্যতম লক্ষণ ।
  • তাছাড়া ক্ষুধা হ্রাস পায় বা থাকে না, জ্বর থাকে এবং পালকসমূহ কুঞ্চিত ভাঁজ করা (ruppled) দৃষ্ট হয়।
  • সবুজ অথবা হলদে রঙের তরল পায়খানা হয় বারবার ৷

চিকিৎসা ব্যবস্থা

  • আর/ সালফামেথাজিন-২ টেবিল চামচ (৫ কেজি পানির সাথে মিশ্রিত করতে হবে) রোগ-লক্ষণ প্রকাশ পাওয়ার পর প্রথমে ২ দিন পানীয় জলের সঙ্গে মিশিয়ে খাওয়াতে হবে। তৎপরে ৩ দিন বন্ধ রাখার পর, আবার সালফামেথাজিন মিশ্রিত পানীয় জল খাওয়াতে হবে।
  • R/ Sulfaquinoxaline sol. 0’05% (to be given with mash) রোগ-লক্ষণ প্রকাশ পাওয়ার পর খাদ্যের সঙ্গে মিশিয়ে প্রথমে ৩ দিন খাওয়াতে হবে। অতঃপর ২ দিন অন্তর অন্তর আবার ম্যাশের সঙ্গে মিশিয়ে খাওয়াতে হবে। রোগ না নিরাময় হওয়া পর্যন্ত অনুরূপভাবে খাদ্যের সঙ্গে মিশিয়ে উপরোক্ত ঔষধটি খাওয়াতে হবে।
  • ১০ লিটার পানীয় জলের সঙ্গে ৫ গ্রাম হস্টাসাইক্লিন R/Hostacycline মিশিয়ে খাওয়ালেও উপকার পাওয়া যাবে। রোগ না নিরাময় হওয়া পর্যন্ত এভাবে হস্টাসাইক্লিন মিশ্রিত পানীয় জল খাওয়াতে হবে।

প্রতিষেধক ব্যবস্থা

  • এই রোগের প্রতিষেধক টীকা (Vaccine) রয়েছে।
  • রোগ আয়ত্তে শানার জন্য অন্যান্য নীরোগ হাঁসদের টীকা দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। S
  • anitation-ব্যবস্থা ভালো করা এই রোগ প্রতিকারের অন্যতম উপায়।
  • রোগলক্ষণ-যুক্ত হাসটিকে পৃথক স্থানে রেখে চিকিৎসা করতে হবে।

আরোও পড়ুন: কবুতরের রাণীক্ষেত রোগের লক্ষণ ও চিকিৎসা

রানীক্ষেত রোগ (Newcastle Disease )

  • এই রোগটিও হাঁসের একটি মারাত্মক রোগ।
  • রোগ দেখা দিলেই যথোপযুক্ত সতর্কতা অবলম্বন করা আবশ্যক।

কারণ

  • এই রোগ এক প্রকার filterable ভাইরাসের দ্বারা সংঘটিত হয় ।
  • এই ভাইরাস পরিপাকযন্ত্র বা শ্বাসযন্ত্রে প্রবেশ করার ফলেই এই রোগ সূচিত হয়ে থাকে ৷
  • এই রোগ অত্যন্ত মারাত্মক এবং সংক্রামক।

লক্ষণ

  • বাচ্চা হাঁসদের মধ্যে সর্দির লক্ষণ প্রকাশ পায়—তারা হাঁচতে থাকে, শ্বাস- কষ্ট উপস্থিত হয়।
  • দুর্বল হয়ে পড়ে, পালকগুলো কুঞ্চিত বা ভাঁজ করা (ruppled) পরিলক্ষিত হয়।
  • কিছুদিনের মধ্যেই অন্যান্য নার্ভাসনেসের লক্ষণাদি প্রকাশ পায়।
  • দু’পায়ের মাঝখানে মাথা গুঁজে বসে থাকে, অথবা কাঁধের দিকে মাথা ঠেকিয়ে রাখে এবং অন্যান্য অস্বাভাবিক লক্ষণাদি প্রকাশ পায় ৷
  • পেছন দিকে হাটে অথবা বৃত্তাকারে ঘুরে বেড়ায়।
  • ডিম পাড়ে এমন স্ত্রী হাঁসদেরও শ্বাসকষ্ট উপস্থিত হয়, কষ্টে হাঁপ টানে বা নাভিশ্বাসের মতো কষ্ট সূচিত হয়, গলা থেকে ঘড় ঘড় শব্দ নির্গত হয়, নিশ্বাস ত্যাগ করার সময় সাঁ সাঁ শব্দ হয় এবং অন্যান্য নার্ভাসনেসের লক্ষণাদি প্রকাশ পায়।
  • ডিম উৎপাদন হ্রাস পায় বা ডিম পাড়া বন্ধ হয়ে যায়, আর ডিম পাড়লেও ডিমের ওপরকার খোলটা খুব নরম থাকে।

চিকিৎসা-ব্যবস্থা

  • এই রোগের কোন ফলপ্রসূ ঔষধ নেই।

প্রতিষেধক ব্যবস্থা

  • উত্তম সেনিটেশন ব্যবস্থা চাই।
  • নতুন কেনা হাঁস বা হাঁসের বাচ্চাদের প্রথমে পৃথক ঘরে রেখে— পর্যালোচনা করতে হবে।
  • নিকটবর্তী অঞ্চলে যদি রানীক্ষেত রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটে থাকে তবে সকল হাঁসকেই প্রতিষেধক টাকা দেবার ব্যবস্থা করতে হবে।

আরোও পড়ুন: বাংলাদেশের পাখি পরিচিত (পর্ব-০১)

সংক্রামক করিজা (Infectious Coryza )

  • হাসেদের এই রোগটি মারাত্মক। তবে চিকিৎসা-ব্যবস্থা ঠিকমত চালাতে পারলে ভয়ের কিছু থাকে না।

কারণ

  • Hemophilus gallinarum এক প্রকার ব্যাকটেরিয়া জনিত কারণে এই রোগ সূচিত হয়ে থাকে।

লক্ষণ

  • নাক থেকে স্রাব নির্গত হয়, সেই আবের রং সাদা বা হলদে।
  • চোখ জলপূর্ণ দৃষ্ট হয়।
  • সময়মত চিকিৎসার ব্যবস্থা না করলে আাবে নানা রন্ধ্র বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়, মুখ ফুলে যায় ।
  • চোখে পিচুটি জমে, চোখ অনবরত বুদ্ধে যায়—ফলে খাদ্যদ্রব্য দেখতে পায় না।
  • দুর্গন্ধ নির্গত হয়, ক্ষুধা হ্রাস পায়।

চিকিৎসা-ব্যবস্থা

  • ০৫ লিটার খাবার পানিতে R/Sulfamerathine ১২.৫% এর ২ চা চামচ মেশাতে হবে
  • ১০০ গ্রাম খাবারের সাথে 1 gm. Sodi-sulfathiazol মিশিয়ে ৪ থেকে ৬ দিন উপরোক্ত ঔষধ খাওয়ালে বিশেষ উপকার পাওয়া যাবে।

প্রতিষেধক ব্যবস্থা

  • ৫ কেজি খাবার পানির সাথে R/ Terramycin P. F. এবং Antigerm 77 এর এক চামচ মেশাতে হবে।
  • অনাক্রান্ত হাঁস বা হাঁসের বাচ্চাদের এই ঔষধটি খাওয়ালে প্রতিষধক ব্যবস্থা গড়ে ওঠে অর্থাৎ এই রোগ হয় না ।

আরোও পড়ুন: কবুতরের রোগ ও চিকিৎসা

দীর্ঘকালস্থায়ী শ্বাসযন্ত্রের রোগ (C. R. D. )

  • এই রোগটি শ্বাসযন্ত্রের রোগ।
  • হাঁসের বাচ্চারাই সচরাচর এই রোগের দ্বারা বেশী আক্রান্ত হয়ে থাকে।

কারণ

  • Mycoplasma gallinarum এক প্রকার বড় আকারের ভাইরাস জনিত কারণে এই রোগ সূচিত হয়ে থাকে।

লক্ষণ

  • হাঁচি, কাশি, নাসাস্রাব ও শ্বাসকষ্ট এই রোগের অন্যতম লক্ষণ ।
  • এই উপসর্গসমূহ দীর্ঘদিন বর্তমান থাকতে পারে।
  • দীর্ঘদিন অন্যবিধ রোগভোগের ফলে অথবা অন্য কোন কারণে দুর্বলতা সূচিত হলে—রোগলক্ষণসমূহ বিশেষ ভাবে প্রকাশ পায় ।

চিকিৎসা-ব্যবস্থা

  • সাড়ে ৪ কেজি পানির সাথে R / Terramycin Liquid এর এক চামচ মিশিয়ে ৪/৫ দিন খাওয়ালে উপকার পাওয়া যাবে।

প্রতিষেধক ব্যবস্থা

  • জীবনীশক্তি বৃদ্ধি করাই এই রোগ প্রতিষেধের অন্ততম ব্যবস্থা হিসাবে বিবেচিত হয়ে থাকে।
  • ইদানীং প্রতিষেধক টীকাও আবিষ্কৃত হয়েছে।
  • অনাক্রান্ত হাঁসের বাচ্চাদের প্রতিষেধক টীকা দেওয়ার ব্যবস্থাও করা যায়।

আরোও পড়ুন: একুরিয়ামের মাছের রোগ ও চিকিৎসা

টাইফয়েড এবং পুলোরাম রোগ (Salmoneosis )

  • হাঁসের বাচ্চারাই এই রোগের দ্বারা বেশী আক্রান্ত হয়ে থাকে।
  • ডিম ফুটে বাচ্চা বেরুবার পর অথবা ৩ সপ্তাহ বয়স্ক বাচ্চাদের মধ্যে এই রোগ প্রকাশ পেতে পারে।
  • বড় স্ত্রী হাসেরাও এই রোগের দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে তবে সেক্ষেত্রে রোগ লক্ষণ তেমন প্রকাশ পায় না ।

কারণ

  • ‘হালমোনেলা’ নামক একপ্রকার ব্যাক্টেরিয়া জনিত কারণে এই রোগ সংঘটিত হয়ে থাকে ।
  • রোগ জীবানুযুক্ত ইনকিউবেটারে বা রোগাক্রান্ত স্ত্রী হাঁসের ডিমে এই রোগবীজাণু বিদ্যমান থাকায়—এই রোগ নবজাতক বাচ্চাদের মধ্যে সূচিত হয়ে থাকে।

লক্ষণ

  • হাঁসের বাচ্চারা দুর্বল হয়ে পড়ে, চলবার সময় টলে টলে পড়ে, ঝিমুতে থাকে, ডানাগুলো ঝোলা অবস্থায় জড়ো হয়ে থাকে।
  • সাদা রংয়ের তরল বাঙ্গ হতে থাকে, সেই চটচটে আঠাল বাহ্য মলদ্বারে আটকে থাকে বা মলদ্বারের চারপাশে চাবড়ার মতো জমে যায়।

চিকিৎসা-ব্যবস্থা

  • R/ Furazolidone (N. F. 180)-0’04% খাবারের সাথে মিশিয়ে নিতে হবে।
  • প্রতি কেজি খাবারের সঙ্গে উপরোক্ত ফুরাজলিজোন ঔষধটি ৯ গ্রাম পরিমাণ মিশিয়ে খাওয়াতে হবে।
  • রোগ নিরাময় না হওয়া পর্যন্ত এই ঔষধটি ম্যাশের সঙ্গে খাওয়ানো বিধেয়।

প্রতিষেধক ব্যবস্থা

  • ইনকিউবেটারে ডিম স্থাপন করার আগে—ইনকিউবেটারটি সম্পূর্ণ- রূপে বীজাণুমুক্ত করে নিতে হবে।
  • পুলোরাম রোগমুক্ত বিশ্বস্ত ফার্ম থেকে হাঁস বা হাঁসের বাচ্চা সংগ্রহ করতে হবে।
  • রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে পুলোরাম রোগ নির্ণয় করা সম্ভব।
  • পুলোরাম রোগযুক্ত ডিম-পাড়া স্ত্রী হাঁসদের অন্যত্র সরিয়ে ফেলতে হবে বা বিক্রয় করে ফেলতে হবে।
  • ঐ ধরনের রোগযুক্ত স্ত্রী হাঁসদের সরিয়ে ফেলার পর হাসের ঘরটি সম্পূর্ণরূপে বিশোধন করতে হবে।

আরেও পড়ুন: গাপ্পি মাছের রোগ ও রোগসমূহের কারণ, লক্ষণ ও চিকিৎসা

খাদ্যে বিষক্রিয়া ( Botulism or limber neck )

  • এ রোগে আক্রান্ত হাঁসেদের বাঁচাতে হলে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিয়ে তদবির করতে হয়।
  • সময়মত ব্যবস্থা গ্রহণ করলে আর রোগের ভয় থাকে না।

কারণ

  • দূষিত তথা বিষাক্ত পায় গ্রহণের ফলেই—এই রোগ সূচিত হয়ে থাকে ।

লক্ষণ

  • খাদ্যজনিত সামান্য বিষক্রিয়ায় দুর্বলতা ও তন্দ্রা সূচিত হয়; ২/৩ দিনের মধ্যে এই উপসর্গাদি বিদূরিত হ’তে পারে।
  • কিন্তু খাদ্যজনিত বিশেষ বিষক্রিয়ার ফলে বিশেষ নিদ্রাভাব লক্ষিত হয়, ঘাড়ের মাংসপেশী পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়-মাথা ও ডানাগুলো মাটিতে ঝুলে পড়ে ।

চিকিৎসা-ব্যবস্থা

  • R / Mag Sulf এর এক চামচ আধা গ্লাস পানির সাথে মিশাতে হবে।
  • ২/৩ দিন খাওয়ালেই রোগ নিরাময় হবে।
  • আধা গ্লাস পানিতে ২ চামচ ক্যাষ্টর অয়েল মিশিয়ে ২ দিন খাওয়ালেও উপকার পাওয়া যাবে।

প্রতিষেধক ব্যবস্থা

  • উত্তম স্যানিটেশন ব্যবস্থা, খাদ্যপাত্রটি পরিষ্কার করে নতুন খাবার সরবরাহ করতে হবে।
  • পঁচা বা দূষিত খাবার খাওয়ানো বন্ধ রাখতে হবে ।

আরেও পড়ুন: বিভিন্ন জাতের গাপ্পি মাছের দাম এবং চেনার উপায় জেনে নিন

বি. দ্র. এই প্রসঙ্গে মনে রাখা দরকার যে, হাঁসের রোগ-ব্যাধি ও চিকিৎসা তার জীবনচক্রে তেমন প্রয়োজন হয় না। অতএব হাঁস পালনের ক্ষেত্রে রোগজনিত তেমন সতর্কতা অবলম্বনের প্রয়োজন হয় না। উকুন বা প্যারাসাইটজনিত রোগ হাসেদের হয় না। কদাচিৎ তারা অন্যবিধ রোগের দ্বারা আক্রান্ত হ’লে— মুরগীর চিকিৎসা-ব্যবস্থার অনুরূপ চিকিৎসা-ব্যবস্থা অনুসরণ করা কর্তব্য।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *