টাইগার বার্ব মাছের সাধারণ পরিচিতি
টাইগার বার্ব যা সুমাত্রা বার্ব নামেও পরিচিত, একটি সুন্দর প্রজাতির অ্যাকুরিয়াম ফিস। এটি একটি ট্রপিকাল বা গ্রীষ্মমন্ডলীয় অঞ্চলের মাছ। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মালয় উপদ্বীপ, ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা ও বোর্নিও দীপপুঞ্জ হলো টাইগার বার্ব মাছের আদিনিবাস। এছাড়াও কম্বোডিয়া, ভারত, থাইল্যান্ড এ এই মাছটি দেখতে পাওয়া যায়। এর মনোহর সৌন্দর্য্যের জন্য একুরিয়াম সৌন্দয্যবর্ধক মাছ হিসেবে ভারত ও থাইল্যান্ড থেকে বাংলাদেশসহ সমগ্র পৃথিবীতে আমদানী করা হয়েছে। টাইগার বার্ব মাছের প্রজনন একুরিয়ামে করাটা অনেক কষ্টসাধ্য হওয়ায় এর বেশী প্রজাতি আনা সম্ভব হচ্ছে না।
টাইগার বার্ব মাছের বৈজ্ঞানিক শ্রেণিবিন্যাস
Kingdom: Animalia
Phylum: Chordata
Class: Actinopterygii
Order: Cypriniformes
Family: Cyprinidae
Sub family: Barbinae
Genus: Puntigrus
Species: Puntigrus tetrazona
টাইগার বার্ব মাছের স্বভাব ও বাসস্থান
টাইগার বার্ব মাছ স্বাদুপানির পানির মাছ। এরা সাধারণত অস্থির স্বভাবের হয়। উন্মুক্ত জলাশয়ে পানির তলদেশের উদ্ভিদ বা বালির কাছাকাছি থাকতে পছন্দ করে।অ্যাকুরিয়ামে থাকলেও এরা উদ্ভিদ পছন্দ করে এবং উদ্ভিদের নিকটবর্তী থাকে। এরা দলবেঁধে থাকতে ও চলতে পছন্দ করে এজন্য এদের ২/৩ জোড়া একসাথে একুরিয়ামে রাখলে ভালো। এরা একুরিয়ামে কম স্থির থাকে অধিকাংশ সময়ই এদের একুরিয়ামের এপাশ থেকে ওপাশ সাঁতরাতে দেখা যায়। অন্য মাছের লেজ ঠোকরানোর অভ্যাস এদের মাঝে লক্ষ্য করা যায়। তবে অনেকের মতে তিন জোড়া বা এর অধিক মাছ একসাথে রাখলে লেজ ঠোকরায় নাহ।
প্রাকৃতিক জলাশয়ে এদের বসবাসের জন্য অনুকূল
তাপমাত্রাঃ টাইগার বার্ব মাছ সাধারণত ২৫°-২৭.৭° সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সুস্থ স্বাভাবিক ভাবে বাঁচতে পারে।তবে তাপমাত্রা এর কম হলে মাছের রঙের বৈচিত্র্যময়তা নষ্ট হয়ে যায়।
পিএইচঃ এরা ৬-৮ পিএইচের মাঝে বেঁচে থাকতে পারে তবে পিএইচ ৬.৫ হলে ভালো হয়।
খরতাঃ টাইগার বার্ব মাছ ৫-১৯ ডিজিএইচ খরতার মাঝে জীবনধারণ করতে পারে। ( ১ ডিজিএইচ = ১৭.৯ মিলিগ্রাম/লিটার =১৭.৯ পিপিএম)
একুরিয়াম ফিসের জগতে লেজ ও রঙ বৈচিত্র্যে সেরা গাপ্পি মাছ পালনের পূর্ণ নির্দেশিকা জানার জন্য পড়ুন..
টাইগার বার্ব মাছের বর্ণনা

আকার ও আকৃতি
টাইগার বার্ব মাছ সাধারণত লম্বায় ৭-১০ সেন্টিমিটার এবং পার্শ্বীয়ভাবে ৩-৪ সেন্টিমিটার হয় যা লম্বার তুলনায় অনেকটা চাপা। কিছু ক্ষেত্রে টাইগার বার্ব মাছ ১৩ সেন্টিমিটার পর্যন্ত হতে পারে। তবে একুরিয়াম ফিস হিসেবে বদ্ধ অবস্থায় থাকলে এই মাছটি তুলনামূলক ছোটই থাকে।
গায়ের রং
টাইগার বার্ব মাছের গায়ে কমলা বা সোনালী বর্ণের মাঝে উল্লম্ব কালো চারটি ডোরার উপস্থিতি লক্ষণীয়। দ্বিতীয় ও তৃতীয় ডোরার মাঝে গোলাকার কালো দাগ দেখতে পাওয়া যায়। পাখনা সাধারণত গাঢ় লাল রঙের হয় যেমন বক্ষ পাখনা ও শ্রোণী পাখনায় রঙ গাঢ় লাল হলেও পৃষ্ঠ পাখনায় লাল এর সাথে কালো দাগ দেখা যায়। এদের পুচ্ছ পাখনা দুইভাগে বিভক্ত থাকে। সবুজ টাইগার বার্ব মাছগুলো সাধারণ টাইগার বার্ব মাছের মতো একই আকারের ও একই প্রকৃতির হলেও এদের দেহে সবুজের গাঢ়ত্ব বেশী থাকে। অ্যালবিনো টাইগার বার্ব মাছ একটি হালকা হলুদ রঙের মাছযার শরীরে চারটি ডোরা কোনোমতে দৃশ্যমান।
টাইগার বার্ব মাছের আয়ুষ্কাল
টাইগার বার্ব মাছ এর জীবনকাল ৭ বছর হয়ে থাকে।
টাইগার বার্ব মাছের জাতসংখ্যা
টাইগার বার্ব মাছের তিনটা জাত বর্তমানে বাজারে পাওয়া যায়।রেড টাইগার বার্ব, গ্রীন টাইগার বার্ব এবং অ্যালবিনো টাইগার বার্ব।
পুরুষ ও স্ত্রী টাইগার বার্ব চেনার উপায়

পুরুষ টাইগার বার্ব আকারে স্ত্রী টাইগার বার্ব এর চেয়ে ছোট হলেও বর্ণিল রঙের হয়ে থাকে। স্ত্রী সদস্যদের শরীর প্রশস্ত হয়।
টাইগার বার্ব মাছের জন্য অ্যাকুরিয়াম সাজানোর কৌশল
টাইগার বার্ব মাছজন্য অ্যাকুরিয়াম সাজানোর কৌশল
১. ২০-৪০ লিটার পানিধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন অ্যাকুরিয়ামের পানির পরিমাণ ৪ এর তিন ভাগ হবে এবং তাপমাত্রা ২৪°-২৬° সেলসিয়াস রাখতে হবে।
২. পানির পিএইচ ৬.৫ এর উপরে রাখতে হবে।
৩. অ্যাকুরিয়ামের পানির খরতা ৭-৯ ডিজিএইচ মাঝে থাকলে ভালো।
৪. যেহেতু টাইগার বার্ব উদ্ভিদের কাছাকাছি থাকতে পছন্দ করে এবং উদ্ভিদের পাতায় ডিম দেয় এজন্য লাইভ প্ল্যান্ট স্থাপন করতে হবে। নুড়ি পাথর দেয়া যেতে পারে তবে খেয়াল রাখতে হবে ক্যামকেল সম্পন্ন কোনো প্ল্যান্ট বা পাথর কিংবা বালি অ্যাকুরিয়ামে দেয়া যাবেনা।
৫. টাইগার বার্ব মাছ এর অ্যাকুরিয়ামে হালকা পানির ফ্লো রাখে এবং একই সাথে পানির ফিল্ট্রেশনের কাজ করে এমন ফিল্টার বা এয়ার পাম্প ব্যবহার করা ভালো। যেমন পাওয়ার ফিল্টার, টপ বা ওভার হেড ফিল্টার কিংবা যেকোনো ধরণের এয়ার স্টোন সহ এয়ার পাম্প যা অ্যাকুরিয়ামে মাছের জন্য আরামদায়ক পরিবেশ তৈরী করে দিবে।
৬. অ্যাকুরিয়ামে যাতে ডিরেক্ট সানলাইট না আসে এটা খেয়াল করবেন তবে দিনের বেলা যেনো বাইরের আলো অ্যাকুরিয়ামে থাকে কেননা এতে মাছের গায়ের রঙটা অনেক সুন্দর আসবে।
৭. অ্যাকুরিয়ামে মাছের জন্য খাবার একসাথে বেশী পরিমাণে দিবেননা। কমিয়ে কমিয়ে দুইবেলা দিবেন প্রয়োজনে। বেশী খাবার দিলে তা নিচে জমে পানি নষ্ট করবে।
৮. প্রতি ৭-১০ দিন পরপর অ্যাকুরিয়ামের পানি পরিবর্তন করলে মাছের শরীর,স্বাস্থ্য, রঙ ও বৃদ্ধির হার ভালো থাকে। তবে পানি পরিবর্তনের ক্ষেত্রে অ্যাকুরিয়ামের নিচের দিক হতে ২০-৩০% পানি ফেলে দিয়ে নতুন পানি দিলে ভালো।

টাইগার বার্ব মাছের খাবার ও খাদ্যাভ্যাস
টাইগার বার্ব মাছ সর্বভুক মাছ। এরা উদ্ভিদজাত, প্রাণীজাত কিংবা শুকনো, সবধরণের খাবারই খেয়ে থাকে। প্রাকৃতিক জলাশয়ে এরা, জুওপ্লাংটন, বিভিন্ন কীটপতঙ্গ, ছোট আকারের মাছ কিংবা বাচ্চা মাছ, উদ্ভিদের পঁচা অংশ কিংবা ক্রাস্টাশিয়ানস এসব খেয়ে বেঁচে থাকে।
অ্যাকুরিয়ামে এরা যেমন জীবন্ত খাবার খায় তেমনি ড্রাই ফুড কিংবা ফ্রোজেন ফুড ও খায়। জীবন্ত খাবারের মাঝে কেঁচো, ব্লাডওয়ার্ম, মশকীর লার্ভা, ছোট মাছ বা ফ্রাই, চিংড়ি ইত্যাদি খেয়ে থাকে। এছাড়াও ফ্লেক্স (flakes), ট্যাবলেট প্যালেট (Tablet pellet), ব্লাডওয়ার্ম (bloodworm), ডাফনিয়া (Daphnia) ও আর্টেমিয়া (Artemia) খেয়েও বাঁচতে পারে। এরা বিভিন্ন শাকসবজি যেমন পুঁইশাক, মটরশুটি এবং মাংস বা কলিজা জাতীয় খাবার টুকরো টুকরো করে দিলেও খেয়ে নেয়। তবে বাচ্চা টাইগার বার্ব মাছের এর জন্য অবশ্যই খাবার গুড়ো করে দিবেন সেটা যে ধরণের খাবারই দেন না কেন। খাবার একসাথে বেশী পরিমাণে দিবেননা।কমিয়ে কমিয়ে দুইবেলা দিবেন প্রয়োজনে।বেশী খাবার দিলে তা নিচে জমে পানি নষ্ট করবে।
টাইগার বার্ব মাছের প্রজনন
টাইগার বার্ব মাছ যখন সাধারণত দৈর্ঘ্যে 2 থেকে 3 সেন্টিমিটার হয় বা বয়সে প্রায় ছয় থেকে সাত সপ্তাহ হয় তখন যৌন পরিপক্কতা লাভ করে। টাইগার বার্ব মাছের পুরুষ সদস্যরা স্ত্রী সদস্যের চেয়ে আকারে ছোট হলেও অনেক বেশী বর্ণিল হয়। স্ত্রী সদস্যদের পেট গোলাকার এবং প্রধানত কালো পৃষ্ঠীয় পাখনা থাকে, অপরদিকে পুরুষ সদস্যদের পৃষ্ঠীয় পাখনার কালো রঙের উপরে একটি স্বতন্ত্র লাল রেখা সহ একটি উজ্জ্বল লাল রঙের নাক ও তুন্ড থাকে।
টাইগার বার্ব মাছের প্রজনন ওভিপোরাস ধরণের। এই মাছের যৌন মিলনের সময় শৃঙ্গার বা পূর্বরাগ (Foreplay) আচরণ লক্ষ্য করা যায়। এরা ডিম পাড়ে এবং ডিম ফুটে বাচ্চা বা ফ্রাই উৎপন্ন হয়। এরা ডিম পাড়ার পর নিজের ডিম নিজেই খেয়ে ফেলে। প্রাকৃতিক পরিবেশে স্ত্রী সদস্যরা জলজ বিভিন্ন উদ্ভিদের পাতায় এবং ডালে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ডিম দেয়।
একুরিয়ামে টাইগার বার্ব মাছের প্রজনন করানো অনেকটা কষ্ট সাধ্য। এজন্য একুরিয়ামে টাইগার বার্ব মাছের প্রজনন এর জন্য একুরিয়ামটিকে একটু ভিন্ন ভাবে সাজাতে হয়।

বাণিজ্যিকভাবে টাইগার বার্ব প্রজননর জন্য একুরিয়াম ব্যবস্থাপনা
১. ১০০-১৫০ লিটার পানি ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন অ্যাকুরিয়ামের পানির পরিমাণ ৪ এর তিন ভাগ হবে এবং তাপমাত্রা ২৪°-২৬° সেলসিয়াস রাখতে হবে।
২. পানির পিএইচ ৬.৫ এর উপরে রাখতে হবে।
৩. অ্যাকুরিয়ামের পানির খরতা ৭-৯ ডিজিএইচ মাঝে থাকলে ভালো।
৪. যেহেতু টাইগার বার্ব উদ্ভিদের কাছাকাছি থাকতে পছন্দ করে এবং উদ্ভিদের পাতায় ডিম দেয় এজন্য লাইভ প্ল্যান্ট স্থাপন করতে হবে। এছাড়াও শেকড় সহ কচুরিপানা বা মপ দিতে পারেন।মাছের ডিম এগুলোর সাথে লেগে থাকবে। নুড়ি পাথর দেয়া যেতে পারে তবে খেয়াল রাখতে হবে ক্যামিকেল সম্পন্ন কোনো প্ল্যান্ট বা পাথর কিংবা বালি অ্যাকুরিয়ামে দেয়া যাবেনা।
অ্যাকুরিয়াম সেটাপ হয়ে গেলে এবার টাইগার বার্ব মাছের কালারফুল পুরুষ সদস্য এবং আকৃতি বড় ও স্বাস্থ্য ভালো এমন স্ত্রী সদস্য নির্বাচন করে অ্যাকুরিয়ামে ছাড়তে হবে।তাদের মিলন বা মেটিং হয়ে গেছে এমনটা বুঝলে পুরুষ সদস্য গুলোকে সরিয়ে ফেলতে হবে। কেননা এদের নিজেদের ডিম খেয়ে ফেলার অভ্যাস আছে । স্ত্রী সদস্যরা ধাপে ধাপে (১-৩) ছড়িয়ে ছিটিয়ে ডিম পাড়ে যা পুরুষ সদস্যরা খেয়ে ফেলতে পারে। আপনি যদি বুঝতে পারেন মা সদস্যদের ডিম পাড়া হয়ে গেছে তবে মা সদস্যদেরও অন্য অ্যাকুরিয়ামে স্থানান্তর করবেন। প্রত্যেক মা টাইগার বার্ব মাছ তাদের পেটে ৭০০ টি পর্যন্ত ডিম ধারণ করলেও সর্বোচ্চ ৫০০ টি ডিম পাড়ার রেকর্ড পাওয়া গেছে। মা টাইগার বার্ব ডিম দেয়ার ২৪-৪৮ ঘন্টার মাঝে ডিম ফুটে বাচ্চা টাইগার বার্ব বা ফ্রাই বের হয়ে আসে যা ৪-৫ দিনের মাঝে সাঁতার ও খাবার খেতে উপযোগী হয়ে উঠে।
বাচ্চা টাইগার বার্ব মাছের খাবার
টাইগার বার্ব মাছের এর জন্য যেকোনো ধরণের খাবার দেয়া যাবে। তবে বাজারের বিভিন্ন দানাদার খাবার দিলে কিংবা বাসায় বানানো যে খাবারই দেননা কেন তা অবশ্যই খাবার গুড়ো করে দিবেন তাতে তা ফ্রাই এর খেতে সহজলভ্য হবে।
টাইগার বার্ব মাছের অ্যাকুরিয়াম সঙ্গী
টাইগার বার্ব মাছ অধিকাংশই শান্তিপ্রিয় ও ঠান্ডা মেজাজের হয়। তবে কিছু মাছের লেজ ঠোকারানোর অভ্যাস আছে তাই লম্বা লেজবিশিষ্ট মাছ এই মাছের সাথে না রাখাই ভালো।
এই মাছের সাথে যেসব মাছ রাখা যায় সেসব হলো ছোট জাতের বার্ব, কয়েক জাতের গাপ্পি, মলি, ছোট জাতের ক্যাট ফিশ, সোর্ড টেল, টেট্রা প্রজাতি, রোসি বার্ব, ছোট জাতের কচ্ছপ, রেইনবো জাতের মাছসমূহ (যেমনঃ বস মণি রেইনবো, স্কার্লেড রেইনবো, রেড রেইনবো ও পিকক রেইনবো ইত্যাদি ; এছাড়াও সার্ক টাইপের মাছসমূহ যেমন এলবিনো রেইনবো সার্ক, ব্ল্যাক রেইনবো সার্ক,সিলভার সার্ক ,রেড টেল সার্ক এবং গোরামি জাতের মাছসমূহ যেমন কোসবি গোরামি, কিসিঙ গোরামি এবং পার্ল গোরামি । এইসব জাতের মাছ গুলোর সাথে অ্যাকুরিয়ামে টাইগার বার্ব মাছ রাখতে পারবেন।
টাইগার বার্ব মাছের দাম
এক জোড়া টাইগার বার্ব মাছের খুচরা বিক্রয়মূল্য ৩০-৪০ টাকা পর্যন্ত হয়।( জুন’২০২২)
রেফারেন্স
টাইগার বার্ব, মেল- ফিমেল
আরোও পড়ুন