মাছের পোনা পরিবহন

মাছের পোনা পরিবহন পদ্ধতি

Posted by:

|

On:

|

,

মাছের পোনা পরিবহন

মাছ চাষের জন্য হ্যাচারি বা নার্সারি অথবা প্রাকৃতিক উৎস হতে পোনা সংগ্রহ করা হয়। পোনা মাছকে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় স্থানান্তরকে পোনা পরিবহন বলে। পোনা পরিবহনের উদ্দেশ্য হলো সুস্থ-সবল পোনা চাষির পুকুরে পৌঁছে দেয়া। সঠিকভাবে পোনা পরিবহন না করলে পোনা মজুদের সময় অথবা পোনা মজুদ করার পর প্রথম সপ্তাহেই অনেক পোনা মারা যায় । তাছাড়া মজুদের পর দুর্বল পোনা সহজেই রোগ-জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে। পরিবহনের সময় বা পোনা মজুদের পর মাছ মারা গেলে মাছ চাষে লাভ কমে যায়, ফলে পোনা ব্যবসায়ীদের প্রতি মাছ চাষিদের আস্থা কমে যাবে।পোনা পরিবহনে দক্ষতা বা সফলতা মাছচাষের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সঠিকভাবে পোনা পরিবহনের উদ্দেশ্য হলো। যত্নসহকারে পোনা পরিবহনের মাধ্যমে পোনার মৃত্যুর হার কমানো।

কী কী পদ্ধতিতে মাছের পোনা পরিবহন করা হয়ে থাকে?

আমাদের দেশে দুই পদ্ধতিতে মাছের পোনা পরিবহন করা হয়ে থাকে। একটি সনাতন পদ্ধতি ও অন্যটি আধুনিক পদ্ধতি

সনাতন পদ্ধতি

সনাতন পদ্ধতিতে পোনা মাছ নার্সারি বা পোনা উৎপাদনের স্থান থেকে মাছচাষির পুকুরে পাতিল (মাটির বা এ্যালুমিনিয়াম), ড্রাম, নৌকায় পোনা পরিবহন করে থাকে।

নৌকায় পোনা পরিবহন

মাছ চাষের শুরু থেকেই আমাদের দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে মৎস্যজীবীগণ ছোট ছোট নৌকার মাধ্যমে পোনা পরিবহন করতেন। নৌকার তলায় কাদা দিয়ে বা কাদা ছাড়া পরিমাণমত পানি রেখে তাতে নদী থেকে পোনা ধরে নৌকার পানিতে রেখে দিতেন। পরবর্তী সময়ে পোনা মাছচাষির পুকুরে সরবরাহ করতেন। নৌকার আয়তনের ওপর পোনার ঘনত্ব নির্ভর করে। দুরবর্তীস্থানে পোনা পরিবহনের ক্ষেত্রে মাঝে মাঝে নৌকার পানি পরিবর্তন করা হয়। বর্তমানে নৌকায় পোনা পরিবহনের খুব বেশি প্রচলন নেই। নৌকায় পোনা পরিবহনে পোনা মৃত্যুর হার অনেক কম।

আরোও পড়ুন: একুরিয়ামের মাছের খাবার এবং খাবার দেওয়ার নিয়ম

পাতিলে পোনা পরিবহন

  • পাতিলে পোনা পরিবহনের ক্ষেত্রে মাটির বা এল্যুমিনিয়ামের পাতিল ব্যবহার করা হয়ে থাকে। তবে মাটির পাতিল তুলনামূলকভাবে ঠাণ্ডা থাকে বলে পোনা বেশি সতেজ বা ভাল থাকে।
  • ২০ থেকে ৩০ লিটার পানি ধরে এমন পাতিলে প্রায় সম্পূর্ণ পানি ভর্তি করে ৩ থেকে ৫ সে.মি. আকারের ৩০০ হতে ৪০০ টি টেকসই করা রুইজাতীয় মাছের পোনা পরিবহন করা যাবে ।।
  • পোনা ভর্তি পাতিলের মুখ জাল বা পাতলা ভিজা কাপড় দিয়ে ঢেকে দিতে হবে যাতে পোনা লাফিয়ে বের হতে না পারে।
  • পোনা পরিবহনের সময় পাত্রের পানিতে বাতাস হতে অক্সিজেন মিশানোর জন্য পাতিল মাঝে মাঝে ঝাঁকি দিতে হবে বা পাতিলের ভিতরে পানি ছিটাতে হবে।
  • পরিবহনকালে মাছের মল-মূত্র পচে অ্যামোনিয়া গ্যাসের সৃষ্টি করে যা মাছের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। সেজন্য দূরে পোনা পরিবহনের সময় দুই ঘণ্টা পর পর পাতিলের পানি তিন ভাগের দুই ভাগ ভাল পানি দ্বারা পরিবর্তন করতে হবে।
  • পাতিলের মুখে ঢাকনা হিসেবে ছোট জাল বেঁধে জালের মাথায় একটি দড়ি লাগিয়ে হাত দিয়ে মাঝে মাঝে দড়ি উপরে-নিচে টেনে বাতাস থেকে পাতিলে অনবরত অক্সিজেন সরবরাহ করা যায়।
  • সাধারণত পরিবহনকারী নিজের মাথায় একটি পাতিল বহন করতে পারে। একটি বাঁশ বা কাঠের দুইপার্শ্বে দুইটি পাতিল বেধে কাঁধের দুইপার্শ্বে পাতিল দুইটি ঝুলিয়ে পরিবহন করতে পারেন। তা’ছাড়া কোন যানবাহন যেমন- রিক্সা, ভ্যান রিক্সা ইত্যাদির মাধ্যমে পোনার পাতিল পরিবহন করা যায়।

ড্রামে পোনা পরিবহন

  • লোহা বা প্লাষ্টিকের ড্রামে পাতিলের চেয়ে তুলনামূলকভাবে একসাথে অনেক বেশি পোনা অধিক দূরত্বে পরিবহন করা যায়।
  • ১৫০ লিটার পানি ধরে এমন ড্রামের তিন ভাগের দুই ভাগ ভাল পানি দ্বারা ভর্তি করে ২ থেকে ২.৫ সে.মি. আকারের ৮,০০০ থেকে ১০,০০০টি টেকসই করা রুইজাতীয় মাছের পোনা পরিবহন করা যায় অথবা ৫ থেকে ৭ সে.মি. আকারের ৬,০০০ থেকে ৮,০০০টি পোনা পরিবহন করা যায়।
  • পোনা ভর্তি ড্রামের মুখ জাল বা পাতলা ভিজা কাপড় দিয়ে ঢেকে দিতে হবে যাতে পোনা লাফিয়ে বের হতে না পারে।
  • পোনা পরিবহনের সময় পাত্রের পানিতে বাতাস হতে অক্সিজেন মিশানোর জন্য ড্রামের ভিতরে পানি ছিটাতে হবে বা হাত দিয়ে ড্রামের ঢাকনা হিসেবে ব্যবহৃত জাল বা কাপড় পানিতে নাড়াতে হবে।
  • দূরে পোনা পরিবহনের সময় দুই ঘণ্টা পর পর ড্রামের তিন ভাগের দুই ভাগ পানি ভাল পানি দ্বারা পরিবর্তন করতে হবে।
  • ড্রামের পানিতে প্রতি ১০০ লিটার পানির জন্য ১ কেজি হারে বরফ দেয়া যেতে পারে। এতে পানির তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে থাকে। ফলে পোনা বেশি সতেজ থাকে।
  • ড্রাম ভর্তি পোনা রিক্সা, ভ্যান-রিক্সা, ট্রাক, নৌকা ইত্যাদি যানবাহনের মাধ্যমে পরিবহন করা যায়।

আরোও পড়ুন: একুরিয়ামের মাছের রোগ ও চিকিৎসা


আধুনিক পদ্ধতি

বর্তমানে সারা বিশ্বের মত আমাদের দেশেও আধুনিক পদ্ধতিতে পলিথিন ব্যাগে অক্সিজেন দিয়ে পোনা মাছ। পরিবহন করা হয়। অনেক সময় ফাইবার গ্লাসের ট্যাংকেও পোনা পরিবহন করা হয়ে থাকে।

পলিথিন ব্যাগে পোনা পরিবহনের সুবিধা

  • ড্রাম বা পাতিলে পরিবহনকালে পাত্রের গায়ে ধাক্কা বা খোঁচা লেগে পোনার দেহে ক্ষতের সৃষ্টি হতে পারে কিন্তু অক্সিজেনসহ পলিথিন ব্যাগে পোনা পরিবহনকালে পোনার শারীরিক ক্ষতির আশংকা থাকে না।
  • সনাতন পদ্ধতিতে পাত্রের পানিতে অক্সিজেনের অভাব দেখা দিতে পারে। তাই সনাতন পদ্ধতি পোনা পরিবহনের ক্ষেত্রে খুব একটা নিরাপদ নয়।
  • অপরদিকে অক্সিজেনসহ পলিথিন ব্যাগে সাধারণতঃ অক্সিজেনের অভাব ঘটে না।সনাতন পদ্ধতিতে পোনা পরিবহন অধিক শ্রমনির্ভর কিন্তু আধুনিক পদ্ধতিতে খুবই কম পরিশ্রমে পোনা পরিবহন করা যায়।
  • সনাতন পদ্ধতি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ, অপরদিকে আধুনিক পদ্ধতি খুবই নিরাপদ ও সুবিধাজনক। আধুনিক পদ্ধতিতে অনেক দূরবর্তীস্থানে সহজেই পোনা পরিবহন করা সম্ভব।

পলিথিন ব্যাগে পোনা পরিবহন পদ্ধতি

  • পোনা মাছ পরিবহনের জন্য সাধারণতঃ ৮০ থেকে ৯০ সে.মি. লম্বা এবং ৫০ থেকে ৬০ সে.মি. চওড়া পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার করা হয়।
  • পলিথিন ব্যাগের চার ভাগের এক ভাগ ভাল পানি দিয়ে ভর্তি করে ঝাঁকি দিয়ে দেখতে হবে পলিথিন।
  • ব্যাগে কোন ছিদ্র আছে কিনা। পলিথিন ব্যাগে ছিদ্র থাকলে অক্সিজেন বের হয়ে পোনা মারা যাবে।
  • সে কারণে ঝুঁকি এড়ানোর জন্য একটি পলিথিন ব্যাগ আরেকটি পলিথিন ব্যাগের ভিতরে নিয়ে পোনা পরিবহন করতে হবে।
  • অক্সিজেন ব্যাগের পানিতে প্রয়োজনীয় সংখ্যক পোনামাছ দিতে হবে।
  • পোনামাছের ঘনত্ব নির্ভর করবে: পোনার প্রজাতি, পোনার আকৃতি, পরিবহনের দূরত্ব ও আবহাওয়ার ওপর।
  • পলিথিন ব্যাগে টেকসই করা পোনা দেওয়ার পর ব্যাগটিকে হালকা চাপ দিয়ে সংকুচিত করে তাতে অক্সিজেন সিলিন্ডারের পাইপটি পানির ভিতর ঢুকিয়ে পলিথিন ব্যাগের অবশিষ্ট চার ভাগের দুই ভাগ অক্সিজেন দ্বারা পূর্ণ করতে হবে।
  • অক্সিজেন পূর্ণ করার পর ব্যাগটি চিকন সুতলি দিয়ে ভালভাবে বেঁধে দিতে হবে।দূরবর্তী স্থানে পোনা পরিবহন করতে হলে পলিথিন ব্যাগ চটের ভিজা ব্যাগে বা শক্ত কাগজের বাক্সে বা কার্টুনে ঢুকাতে হবে।

আরোও পড়ুন: শীতে কবুতরের সুরক্ষায় আপনার করণীয়

ফাইবার গ্লাসের ট্যাংকে পোনা পরিবহন

  • প্রচুর পরিমাণে পোনা পরিবহনের জন্য দুই দেয়াল বিশিষ্ট তাপ নিরোধক বড় আকারের (প্রায় একহাজার লিটার পানি ধরে) ফাইবার গ্লাস ট্যাংক ব্যবহার করা হয়। আমাদের দেশে এ পদ্ধতি বহুল প্রচলিত নয়।
  • ১,০০০ লিটার পানি ধরে এমন ফাইবার গ্লাসের ট্যাংকে ৮০০ থেকে ৯০০ লিটার ভাল পানি নিতে হবে।এতে ৫-৭ সে.মি. সাইজের ৩০,০০০ হতে ৪০,০০০টি টেকসই করা রুইজাতীয় পোনা পরিবহন করা যাবে।
  • ট্যাংকের মুখ জাল দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে যাতে পোনা লাফিয়ে বাহিরে না যেতে পারে। এ ধরনের ট্যাংকে খুবই সহজে ৪ থেকে ৫ ঘন্টা দূরত্বে পোনা পরিবহন করা যায়।
  • মাঝে মাঝে পানি পরিবর্তন করতে পারলে আরও ভাল। তা’ছাড়া ট্যাংকের পানিতে অক্সিজেন সরবরাহ করার জন্য ব্যাটারিচালিত ‘এজিটেটর’ দিলে পানিতে অক্সিজেনের অভাব হয় না।

চিংড়ির পিএল পরিবহন

  • আমাদের দেশে বর্তমানে আধুনিক পদ্ধতিতে পলিথিন ব্যাগে দূরবর্তী স্থানে এবং স্বল্প দূরত্বে পরিবহনের জন্য সনাতন পদ্ধতিতে এলুমিনিয়ামের পাতিলে চিংড়ির পিএল পরিবহন করা হয়ে থাকে ।
  • আধুনিক বা সনাতন যে পদ্ধতিতেই পরিবহন করা হোক না কেন পিএল-এর পরিবহন ঘনত্ব মূলতঃ নির্ভর করে এদের আকার এবং পরিবহন দূরত্বের ওপর।
  • সাধারণভাবে ৬০ সে.মি. লম্বা ও ৪০ সে.মি. চওড়া আকারের পলিথিন ব্যাগ পিএল পরিবহনে ব্যবহৃত হয়।
  • আধুনিক পদ্ধতিতে গলদা চিংড়ির পিএল ও রুইজাতীয় পোনা পরিবহন প্রায়ই একই রকম। চিংড়ির পিএল বিভিন্ন দূরত্বে পরিবহনের ক্ষেত্রে উপরে উল্লেখিত ঘনত্ব অনুসরণ করা যেতে পারে।
  • পলিথিন ব্যাগের উপরে চটের ব্যাগের পরিবর্তে বর্তমানে পিএল ভর্তি পলিথিন ব্যাগ ককশিটের প্যাকে ভরে পরিবহন করা হয় এবং পলিথিন ব্যাগ ও ককশিটের মধ্যবর্তী স্থানে বরফ দেয়া হয়, ফলে সঠিক তাপমাত্রা বজায় থাকে।

পরিবহনকালীন পরিচর্যা

  • পোনা নাড়াচাড়ার সময় পোনার দেহের পিচ্ছিলতা (শ্লেষ্মা) যেন চলে না যায়।
  • সরাসরি পোনা হাত দিয়ে না ধরে হ্যান্ড নেট বা জাল অথবা নরম কাপড় ব্যবহার করতে হবে।
  • পরিবহন পাত্র ভিজা কাপড় বা চট দ্বারা ঢেকে রাখতে হবে।
  • পরিবহনকালে পাত্রের তাপমাত্রা কম রাখতে হবে। সেজন্য পরিবহনকালে পোনার পাত্র ব্যাগ ছায়াযুক্ত স্থানে রাখতে হবে।
  • পাত্রের মধ্যে মাত্রাতিরিক্ত পোনা পরিবহন করা যাবে না।
  • বিভিন্ন আকারের ও প্রজাতির পোনা একত্রে পরিবহন করা ভাল না।
  • পলিথিন ব্যাগে যাতে টিনের কোনা, পেরেক বা অন্য কোন শক্ত বস্তুর আঘাত না লাগে সেদিকে খেয়ালরাখতে হবে।
  • পাতিল বা ড্রামে পরিবহনকালে পাত্রের পানি নাড়াচাড়া করতে হবে।
  • মৃত পোনা সাথে সাথে পাতিল বা ড্রাম হতে অপসারণ করতে হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *